Connect with us

ওটিটি

‘কাইজার’ ও ‘সিন্ডিকেট’: ওটিটিতে অসামান্য আফরান নিশো

সিনেমাওয়ালা রিপোর্টার

Published

on

আফরান নিশো

‘কাইজার’ ওয়েব সিরিজে আফরান নিশো (ছবি: ফেসবুক)

এবারের ঈদে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুক্তিপ্রাপ্ত ওয়েব সিরিজের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ও প্রশংসিত হচ্ছে তানিম নূর পরিচালিত ‘কাইজার’ এবং শিহাব শাহীনের ‘সিন্ডিকেট’। দুটিতেই অনবদ্য নৈপুণ্য দেখিয়েছেন আফরান নিশো। মূলত তার অসাধারণ অভিনয়ের সুবাদে সিরিজ দুটি দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। তার ভক্তরা তো দারুণ উচ্ছ্বসিত। এবারের ঈদে ওটিটিতে তিনিই দর্শক মাতিয়েছেন।

আফরান নিশোর প্রতি বরাবরই ভিন্ন আগ্রহ থাকে দর্শকদের। তিনি নিজেকে ভেঙেচুরে উপস্থাপন করেছেন সিরিজ দুটিতে। তিনি কতটা বড় মাপের অভিনেতা হয়ে উঠেছেন, দুটি সিরিজে সেই প্রমাণ পাওয়া গেলো। তার সবচেয়ে পরিণত পারফরম্যান্স অনেকের চোখে এই দুটি।

ভারতীয় ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হইচইয়ে মুক্তি পাওয়া পূর্ণাঙ্গ গোয়েন্দা থ্রিলার ‘কাইজার’ সবার মুখে মুখে। সিরিজটি দেখে দর্শকরা সোশ্যাল মিডিয়ায় আফরান নিশোকে ফুল মার্কস দিয়েছেন। অনেকের মন্তব্য, ডিএমপির এডিসি কাইজার চৌধুরী চরিত্রটি জনপ্রিয় এই অভিনেতার ক্যারিয়ারে অন্যতম সেরা পারফরম্যান্স। গোয়েন্দা সিরিজটিতে নিজেকে শতভাগ নিংড়ে দিয়েছেন তিনি। তার অভিনয় গুণে অর্থবহ হয়েছে সিরিজটি।

আফরান নিশো

আফরান নিশো (ছবি: ফেসবুক)

একজন সহজাত গোয়েন্দা কর্মকর্তার ঠিক যেমন হওয়া প্রয়োজন; কাঁচাপাকা চুল, দাড়ি আর পাঁচ কেজি ওজন বাড়িয়ে আফরান নিশো নিজেকে সেভাবেই উপস্থাপন করেছেন। কাইজার চরিত্রে তার বিকল্প ভাবা মুশকিল। তার প্রতিদ্বন্দ্বী তিনি নিজেই। কাইজারের ভূমিকায় পুরোপুরি নিখুঁত তিনি। কাইজার ও নিশো যেন পর্দায় নেমসেক হয়ে উঠেছেন। কাইজারকে নিজের মতো করে দুর্দান্তভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন নিশো। মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাভাবনা থেকে শুরু করে বন্ধুত্বের টানাপোড়েন, সবক্ষেত্রে ছিলো তার অনবদ্য অভিনয়। ৯ পর্বের সিরিজ জুড়ে দারুণ অভিনয় করে গেছেন তিনি।

গল্পের শুরুতে রাজধানীর গুলশানে একটি ফ্ল্যাটে প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান জয়া ও সাবার গলা কাটা লাশ পাওয়া যায়। জোড়া খুনের রহস্য উদঘাটনের দায়িত্ব এসে পড়ে এডিসি কাইজার চৌধুরীর ওপর। কনসোল হাতে ভিডিও গেমের প্রতি আসক্তির কারণে তার পারিবারিক জীবনে ঘটে অশান্তি। তার কাছে গেম আগে, বাকি সবকিছু পরে। গেম খেলা নিয়ে কেউ কিছু বললে বদমেজাজি কাইজার বিগড়ে যান। পরিবার ও কাছের মানুষের সঙ্গে তার দূরত্ব তৈরি হয়। অগোছালো এই মানুষটির বিয়েবিচ্ছেদ হয়েছে। ব্যক্তিজীবনে তিনি বয়ে বেড়ান সম্পর্কে ব্যর্থ হওয়ার গ্লানি। নিজের প্রতি ন্যূনতম যত্ন নেন না।

হত্যা মামলার কুলকিনারা করার ভার পাওয়া কাইজারের রক্ত দেখলে বমি আসে। তদন্তের কাজে গিয়ে ঘুমে ঢলে পড়েন। শরীরের অবস্থা ভালো না। কিন্তু গোয়েন্দা হিসেবে তিনি প্রথম শ্রেণির। বুদ্ধিদীপ্ততার জন্যই টিকে আছেন চাকরিতে। তার সেন্স অফ হিউমার অপূর্ব। দক্ষ গোয়েন্দা হিসেবে তীক্ষ্ণ মস্তিষ্কের সঙ্গে দারুণ স্মৃতিশক্তির প্রভাব আছে তার।

বাবা হিসেবে খুব যত্নশীল কাইজার। সিরিজের শুরু থেকে নিকিতাসহ বিভিন্ন চরিত্রের সঙ্গে কাইজারের মিথস্ক্রিয়া ভালো লাগার মতো। মেডিকেল স্টুডেন্ট অনন্ত কাইজারের গেম-মেট। কাইজারের নিঃসঙ্গ জীবনের অন্যতম সঙ্গী। জোড়া খুনের রহস্য উন্মোচনের পাশাপাশি একজন গোয়েন্দার জীবনের হতাশা, সংকট, দুর্দশা, টানাপোড়েন আলাদাভাবে গুরুত্ব পেয়েছে সিরিজে। ছোটবেলায় তিন গোয়েন্দার মতো নিজেদের ভাবা কাইজার ও তার দুই বন্ধু বড় হয়ে গোয়েন্দা, অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও আইটির মানুষ হয়ে মামলাটিতে জড়িয়ে যায়। অম্লান, তন্ময়, কাইজার ও শিরিনের ছোটবেলার ছোট একটি দৃশ্য সিরিজটির শুরুতে দর্শকের মনে ছাপ ফেলেছে। মাল্টিডাইমেনশনাল গল্পের জন্য ওয়েব সিরিজটি দর্শকদের ভালো লেগেছে। কাইজারের জীবনের তিনটি আলাদা গল্প সমান্তরালে চলেছে এবং খুব সুন্দরভাবে তিনটি গল্প একসঙ্গে মিশে কাইজার চরিত্রটিকে পূর্ণতা দিয়েছে।

আফরান নিশো

‘সিন্ডিকেট’ ওয়েব সিরিজে আফরান নিশো (ছবি: ফেসবুক)

আফরান নিশোর দুর্দান্ত অভিনয়ের একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। তন্ময়ের জন্মদিনের পার্টিতে অম্লানের সঙ্গে কাইজারের উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় ও অভিব্যক্তি এককথায় অতুলনীয়। একজন মানুষের দুর্বল পয়েন্ট নিয়ে যখন কথা বলা হয়, ওই মানুষটার আচরণ হয় ভয়াবহ। এমন একটি পরিস্থিতিতে নিশো ঠিক তেমনই ভয়ংকর সুন্দর ছিলেন।

অভিনয়ের দিক থেকে আফরান নিশোর পর সবচেয়ে বেশি আলো কেড়েছেন ইমতিয়াজ বর্ষণ। বরফ-শীতল খল চরিত্র ব্যারিস্টার মোক্তার মাহমুদ জফরি হিসেবে কথা বলার ধরন ও অভিব্যক্তি অসাধারণ। এছাড়া প্রত্যেক অভিনয়শিল্পীর পারফরম্যান্স এককথায় দারুণ। তারা হলেন মোস্তাফিজুর নূর ইমরান, রিকিতা নন্দিনী শিমু, শতাব্দী ওয়াদুদ, দীপান্বিতা মার্টিন, স্বাগতা, সুমন আনোয়ার, নাজিবা বাশার, আইশা খান, হৃদ্ধি, সৌম্য জ্যোতি, নাদের চৌধুরী, শাহেদ আলী। অতিথি চরিত্রে আহমেদ রুবেল মুগ্ধ করেছেন।

‘খুন করে ধরা না পড়া একটা আর্ট। আর আমি সেই আর্টের ক্রিটিক’ সংলাপটির মাধ্যমে আফরান নিশো বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি এই সিরিজের হর্তাকর্তা। আরেকটি দারুণ সংলাপ, ‘ফ্রেন্ডশিপ একটা সেটমেন্যুর মতো। নিলে সবগুলোই নিতে হবে।’ এমন সব চমৎকার বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপের জন্য বাহবা পাচ্ছেন আয়মান আসিব স্বাধীন। তার বয়স মাত্র ২৬ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ থেকে পড়াশোনা করেছেন এই তরুণ।

ফেলুদা, ব্যোমকেশ, তিন গোয়েন্দা অথবা শার্লক হোমস পড়ে বা এসব চরিত্র নিয়ে বানানো কন্টেন্ট দেখে বড় হওয়া দর্শকদের একজন নির্মাতা তানিম নূর। ‌‘কাইজার’ নির্মাণে তার অনুপ্রেরণা এগুলোই। তানিম নূরের নির্মাণ গুণে ‘কাইজার’ আলোচিত সিরিজ হয়ে উঠেছে।

‘কাইজার’ ওয়েব সিরিজের ভাবনা, গল্প, চিত্রনাট্য ও অভিনয় সবই ভালো। এসবের চমৎকার সংমিশ্রণে উপভোগ্য একটা সিরিজ উপহার দেওয়ার মূল কৃতিত্ব তানিম নূরের। সিরিজের ইন্ট্রোডাকশনে আশি ও নব্বই দশকের ঢাকা শহরের ফুটেজ ব্যবহার হয়েছে। এর ফলে যোগ হয়েছে অন্যমাত্রা। ইন্ট্রোতে বাংলাদেশি ব্যান্ড ইআইডিএ’র ‘নাইটড্রাইভার’ গানটি রয়েছে।

ওয়েব সিরিজটি সাজানো হয়েছে ৯ পর্বে। এগুলোর নাম স্টোরি মোড, চেক পয়েন্ট, দ্য গ্লিচ, নন-প্লেয়ার ক্যারেক্টার, মাল্টিপ্লেয়ার মোড, আরপিজি, আরকেড মুড, বস লেভেল এবং ওয়াক থ্রো। প্রতি পর্বের দৈর্ঘ্য ২০ মিনিট থেকে সর্বোচ্চ ৩৯ মিনিট। ৪ ঘণ্টা ১৮ মিনিট ব্যাপ্তির এই জমজমাট সিরিজটি প্রযোজনা করেছে সিন্ডিকেট ফিল্মস।

কাকতালীয় হলো, ‘কাইজার’-এর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের নামে চরকিতে মুক্তি পাওয়া ‘সিন্ডিকেট’ ওয়েব সিরিজের মাধ্যমেও আফরান নিশো মুগ্ধ করেছেন দর্শকদের। তার সুবাদেই এটি উপভোগ্য লেগেছে দর্শকদের। আদনান চরিত্রে তার অভাবনীয় পারফরম্যান্স ও লুক আলোচিত হয়েছে। টানটান উত্তেজনা ও থ্রিলারে ভরপুর সিরিজটিতে এই তারকার অভিনয়ের ধারাবাহিকতা, চরিত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ও অ্যাডাপ্টেশনে মুগ্ধ দর্শকরা।

পুরোপুরি মানসিকভাবে অসুস্থ তরুণের চরিত্রে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন আফরান নিশো। সংলাপ ডেলিভারি, মুখের অভিব্যক্তি এবং সাদাত হোসাইনের ‘কাজল চোখের মেয়ে’ কবিতার আবৃত্তিসহ সবখানেই আদনানকে ধারণ করতে পেরেছেন তিনি।

সিন্ডিকেট

‘সিন্ডিকেট’ ওয়েব সিরিজের অভিনয়শিল্পী (ছবি: ফেসবুক)

সাত পর্বে সাজানো ‘সিন্ডিকেট’ সিরিজের গল্পে দুটি আলাদা সম্পর্ক, আবেগ ও পরিস্থিতি উঠে এসেছে। একদিকে আছে ব্যাংক অব বেঙ্গলে কর্মরত জিশা ও তার প্রেমিক আদনানের ব্যক্তিজীবন। অন্যদিকে আছে একটি গোপন সিন্ডিকেটের ভয়ংকর বেড়াজালে আটকে পড়ার গল্প।

অস্বাভাবিক চরিত্রে আফরান নিশো অনবদ্য। জিশার সহকর্মী আদনান আইটি বিভাগে বসে। সে আর দশজনের মতো স্বাভাবিক নয়। অ্যাসপারগার সিনড্রোম তাকে ব্যতিব্যস্ত রাখে। খুব কাছের মানুষ বাদে সে অন্য কারও আচরণ ও স্পর্শ সহজভাবে নিতে পারে না। আদনান ও জিশা একে অন্যের নির্ভরতায় বিয়ে করতে চায়। কিন্তু কঠিন বাস্তবতা আলাদা করে দেয় জিশাকে। ওলোটপালট হয়ে যায় আদনানের পৃথিবী। আদনান কীভাবে জিশার বলে যাওয়া কথা ধরে সত্য উন্মোচন করবে সেটাই সিরিজের টাইমলাইন। দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার একটি নিগূঢ় সত্য উঠে এসেছে সিরিজে।

প্রথম পর্ব থেকেই চমৎকার গল্পের যথাযথ গতি ও টানটান উত্তেজনায় পরবর্তী পর্ব দেখার আগ্রহ জন্মে। জিশা চরিত্রে নাজিফা তুষি অসাধারণ অভিনয় করেছেন। ব্ল্যাকমেইলে বিপর্যস্ত মেয়ের চোখে-মুখে অস্থিরতা ফুটিয়ে তুলতে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন তিনি। জিশার সঙ্গে একই ব্যাংকে কর্মরত স্বর্ণার ভূমিকায় তাসনিয়া ফারিণকে পরিপূর্ণ মনে হয়েছে। এছাড়া নাসির উদ্দিন খান, শতাব্দী ওয়াদুদ, রাশেদ মামুন অপু, সমু চৌধুরী, এলিনা শাম্মী স্বভাবসুলভ অভিনয় করেছেন।

শিহাব শাহীনের আগের দুই ওয়েব সিরিজ ‘আগস্ট ১৪’ কিংবা ‘মরীচিকা’ অল্প বা বিস্তৃত পরিসরে দেশে ঘটে যাওয়া দুটি সত্যি ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত। ফলে দর্শকরা সিরিজ দুটির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পেরেছে অনায়াসে। তবে ডিজাইন, চিত্রনাট্য ও নির্মাণসহ সব মিলিয়ে ‘সিন্ডিকেট’কে শিহাব শাহীনের সেরা সিরিজ বলা যায়। তিনি একটি আবেগপ্রবণ গল্পের সঙ্গে সমসাময়িক ইস্যুর সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন এতে। সিরিজ হিসেবে ‘সিন্ডিকেট’ দেখার মতো কনটেন্ট। পরিচালক, অভিনয়শিল্পী, চিত্রগ্রাহক কামরুল ইসলাম শুভসহ সবাই মিলে শক্তিশালী সিন্ডিকেটেরই বহিঃপ্রকাশ।

সিনেমাওয়ালা প্রচ্ছদ