Connect with us

ওটিটি

‘কারাগার’ যেসব কারণে সবচেয়ে ভালো বাংলা ওয়েব সিরিজ

সিনেমাওয়ালা রিপোর্টার

Published

on

চঞ্চল চৌধুরী

‘কারাগার’ ওয়েব সিরিজে চঞ্চল চৌধুরী (ছবি: হইচই)

এতো সুন্দর গল্প! এতো সুন্দর চিত্রনাট্য! এতো সুন্দর গাঁথুনি! এতো সুন্দর নির্মাণ! এতো সুন্দর অভিনয়! এতো নিখুঁত! সৈয়দ আহমেদ শাওকীর দ্বিতীয় ওয়েব সিরিজ ‘কারাগার’ নিয়ে দুই বাংলার দর্শকদের এমন মুগ্ধতা। তাদের মতে, ভালো কাহিনি ও ভালো বাহিনীর মিশেলে দুর্দান্ত ও অসাধারণ একটি কাজ এটি। ফলে এর কলাকুশলীরা এখন টুপি খোলা অভিবাদনে সিক্ত হচ্ছেন।

শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রহস্য, সাসপেন্স ও থ্রিল ছিলো। শেষ দৃশ্যের সুবাদে পার্ট-২ দেখার অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে সবাই। শেষের ক্লাইম্যাক্সে যে চমক রয়েছে, সেটাকে ঘিরেই পুরো সিরিজ। শেষ দৃশ্যের একটি শব্দ দর্শককে দ্বিতীয় পর্ব দেখার জন্য আটকে রাখলো!

‘কারাগার’ দেখা শেষে অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশ্ন রেখেছেন, “এরপর কী? এটা ঠিক না! দ্বিতীয় সিজনের জন্য মুখিয়ে আছি। সাবাশ ‘কারাগার’ টিম! প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করেছি।”

সংগীতশিল্পী বাপ্পা মজুমদার, অভিনেতা শতাব্দী ওয়াদুদ ও অভিনেত্রী জাকিয়া বারী মম অভিনন্দন জানিয়েছেন ‘কারাগার’ সংশ্লিষ্টদের।

তাসনিয়া ফারিণ

‘কারাগার’ ওয়েব সিরিজে তাসনিয়া ফারিণ (ছবি: হইচই)

ভারতের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত ‘কারাগার’ সিরিজের রিভিউতে বলা হয়েছে, ‘পরিণত সৃজনশীলতা, দারুণ গোছানো ও পরিশীলিত কাজ। প্রতিটি দৃশ্যে দুর্দান্ত টিমওয়ার্কের ছায়া সুস্পষ্ট।’

সমালোচকরা মনে করেন, ভালো টিমওয়ার্কের ফসল ‘কারাগার’। এতে থ্রিলার-মিস্ট্রি জনরার অসাধারণ একটি গল্প রয়েছে। গল্প বলার ধরন এককথায় খুবই অন্যরকম। প্রতিটি পর্বে টানটান উত্তেজনা থাকায় ‘কারাগার’কে চূড়ান্ত সফল বলা যায়।

ভারতীয় দর্শকরা সিরিজটির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। দুই বাংলা মিলিয়ে তাদের দেখা সেরা সিরিজ এটাই। কেউ কেউ বলেছেন, ‘বাংলাদেশ ভালো বাংলা কন্টেন্টে দর্শকদের বিশ্বাস ফিরিয়ে আনছে।’

চঞ্চল চৌধুরী

‘কারাগার’ ওয়েব সিরিজে চঞ্চল চৌধুরী (ছবি: হইচই)

সোশ্যাল মিডিয়ায় সাধারণ দর্শকরা উল্লেখ করেছেন, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে পরিশীলিত ওয়েব সিরিজ ‘কারাগার’। কেউবা মনে করেন, এটি নিঃসন্দেহে সবচেয়ে ভালো বাংলা ওয়েব সিরিজের তালিকায় অন্যতম।

গত ১৯ আগস্ট ভারতীয় ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হইচই’য়ে মুক্তি পায় সাত পর্বের ‘কারাগার’। প্রতিটির ব্যাপ্তি ২৫-৩০ মিনিট। প্রথম পর্ব থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত বিরাজ করেছে রহস্যঘেরা পরিবেশ। একের পর এক রহস্য ভাবিয়ে তোলে দর্শকদের। শেষ দেড় মিনিটের আগ পর্যন্ত মূল চরিত্র ছিলো পুরোপুরি রহস্যময়। শেষের দৃশ্যে এসেও রহস্য পুরোপুরি খোলাসা করা হয়নি, বরং রহস্য যেন আরো বেড়েছে।

চিত্রগ্রাহক রাশেদ জামানের মতে, ‘গল্প জানার আগ্রহটা এক পর্ব থেকে আরেক পর্বে বহমান ছিলো শেষ পর্যন্ত।’

চঞ্চল চৌধুরী

চঞ্চল চৌধুরী ও সৈয়দ আহমেদ শাওকী (ছবি: ফেসবুক)

শাওকীর আরেকটি ছক্কা!
‘তাকদীর’-এর পর ফের একসঙ্গে দারুণ কাজ করেছেন সৈয়দ আহমেদ শাওকী ও চঞ্চল চৌধুরী জুটি। ‘কারাগার’ শাওকীর আরেকটি পরিপূর্ণ ও অসাধারণ নির্মাণ। তিনি শুরু থেকেই পরিণত, এবার আরো অভিজ্ঞ হলেন। ভক্তদের কথায়, শাওকী আরেকটি ছক্কা হাঁকালেন। তার হাত ধরে আরেকটি ভালো সিরিজ পেলো দর্শকরা। এটিকে অসাধারণ বললে কম হয়ে যায় বলে মনে করেন কেউ কেউ। শাওকীর ‘তাকদীর’ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন যারা, তাদের চোখে ‘কারাগার’ সিরিজে সবকিছু পিন পয়েন্টে দেখিয়েছেন তিনি। সেদিক থেকে তাকে সেরা নির্মাতাদের কাতারে রাখাই যায়। তার এই নির্মাণ চমৎকার লেগেছে সবার। কারও মন্তব্য, ‘নেটফ্লিক্সের মৌলিক কন্টেন্টও ধরাশায়ী এই সিরিজের কাছে।’

চঞ্চল চৌধুরী

‘কারাগার’ ওয়েব সিরিজে চঞ্চল চৌধুরী (ছবি: হইচই)

২৫০ বছর ধরে বন্দি!
কারাগারে একরাতে রহস্যময় একজন কয়েদিকে খুঁজে পাওয়ার মধ্য দিয়ে সিরিজের গল্প এগিয়েছে। তার দাবি, সে মীরজাফরকে হত্যা করেছে এবং ২৫০ বছর ধরে কারাগারে বন্দি! একজন মানুষ কীভাবে ২৫০ বছর ধরে বেঁচে আছে? এ কি আদৌ সম্ভব? ১৪৫ নম্বর সেলে তার খোঁজ মেলে। ১৪৫ নম্বর সেলে কোনো কয়েদিকে রাখা হলে সে আত্মহত্যা করে। তাই প্রায় ৫০ বছর ধরে সেলটি বন্ধ ছিলো। কিন্তু বন্ধ কারাগারের কুঠুরিতে মানুষটি এলো কীভাবে?

কারাগারে মোট কয়েদি ৩২৫ জন। একরাতে কয়েদি গোনার সময় অতিরিক্ত একজনকে পাওয়া যায়। লোকটা কথা বলতে পারে না, কানে শোনে না। তবে ইশারা ভাষা (সাইন লাঙ্গুয়েজ) বোঝে। মানুষটি কে? সে কি জিন? মানুষটি সত্যিই কি ২৫০ বছর ধরে বেঁচে আছে? তার বলা অবাস্তব কথাগুলো আদৌ সত্যি কিনা, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো গল্প আছে? রহস্যময় কয়েদির আবির্ভাব এবং সেই সঙ্গে বিভিন্ন বাস্তবিক উপকাহিনী নিয়ে সাজানো হয়েছে সাত পর্বের ওয়েব সিরিজ ‘কারাগার পার্ট-১’।

তাসনিয়া ফারিণ

‘কারাগার’ ওয়েব সিরিজে তাসনিয়া ফারিণ (ছবি: হইচই)

মূল প্লটের বাইরে ৩ ঘন্টা ৭ মিনিটের সিরিজটিতে কয়েকটি সাবপ্লট আছে। সব মিলিয়ে অনেক প্রশ্ন জমেছে দর্শকদের মনে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গল্পে একটা উত্তেজনা বিরাজ করেছে। সিরিজ যতো এগিয়েছে, ততোই জটিল সব প্রশ্নের উদয় হয়েছে। ‘কারাগার পার্ট-১’ শেষে মূক ও বধির মানুষটির জট খুললো নাকি বেশি করে লাগলো? কে এই মানুষ যে ২৫০ বছর বেঁচে আছে? এত বছর বন্ধ থাকা সেলে কীভাবে এলো সে? পুরাতন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সিরিজের পুরো শুটিং একটানা শেষ হয়েছে। ফলে ‘কারাগার পার্ট-২’-এর জন্য বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না দর্শকদের!

চঞ্চল চৌধুরী

‘কারাগার’ ওয়েব সিরিজে চঞ্চল চৌধুরী (ছবি: হইচই)

দুর্দান্ত চঞ্চল চৌধুরী
‘কারাগার’ সিরিজের মূল আকর্ষণ চঞ্চল চৌধুরীর অসাধারণ অভিনয়। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন চরিত্রে নিজেকে ছাপিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তাকে দর্শক যতোই দেখছে, ততোই অভিভূত হচ্ছে। দর্শকরা তার এবারের অভিনয়কে দারুণ, দুর্দান্ত, অসাধারণ ও চমৎকারসহ নানান বিশেষণ দিয়েছেন। কারও চোখে, তিনি বাংলাদেশের ‘টম হ্যাঙ্কস’। কেউ কেউ তো তাকে বাংলাদেশের সর্বকালের অন্যতম সেরা অভিনেতা মনে করেন।

অনেকের মতে, চঞ্চল চৌধুরী অভিনয় জগতের রাজা। কোনো বাক্য উচ্চারণ না করেও পুরো সিরিজ জুড়ে দর্শকদের আটকে রেখেছেন। কোনো কিছু না বলেও অনবদ্য অভিনয় দক্ষতা দেখিয়েছেন। কিছু না বলেই কতো কথা বলে দিলেন তিনি! কোনো কথা না বলে শুধু অভিব্যক্তি দিয়ে পুরো সাত পর্বের সিরিজটি যেভাবে টেনেছেন এই অভিনেতা, এককথায় অসাধারণ। যার কোনো সংলাপ নেই, তার অভিনয়শৈলীর গভীরতা কতো বেশি তা সহজে পরিমাপ করা যায়। সংলাপহীন সবখানে চোখে-মুখে তার নীরব অভিব্যক্তিগুলো খুবই সুন্দর লেগেছে দর্শকদের।

চঞ্চল চৌধুরী

‘কারাগার’ ওয়েব সিরিজে চঞ্চল চৌধুরী (ছবি: হইচই)

চঞ্চল চৌধুরীর গল্প বেছে নেওয়া এবং চরিত্রের ভেতর ঢুকে যেতে পারার ক্ষমতা অন্যমাত্রার মনে করেন ভক্তরা। তারা গর্ব করে বলে, ‘আমাদের দেশে চঞ্চল চৌধুরী নামে একজন জাদুকরী অভিনয়শিল্পী আছেন।’

সোশ্যাল মিডিয়ায় কেউ কেউ তো রসিকতার সুরে বলেছেন, ‘ভদ্রলোকের হাতে পরশপাথর আছে। যেখানেই হাত দিচ্ছেন সোনা ফলছে। তিনিই সেরা।’

‘তাকদীর’-এর পর ‘কারাগার’ চঞ্চলের আরেকটি মাস্টারপিস কাজ। মূক-বধির চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয়ে দর্শককে মুগ্ধ করেছেন তিনি।

চঞ্চল চৌধুরী

‘কারাগার’ ওয়েব সিরিজে চঞ্চল চৌধুরী (ছবি: হইচই)

চঞ্চল চৌধুরী নিজের সবশেষ চারটি কাজের প্রসঙ্গ টেনে সোশ্যাল মিডিয়ায় বলেন, ‘পাপ-পুণ্য’র হিসাব মিটিয়ে ‘হাওয়া’য় ভেসে আমার ঠিকানা এখন ‘কারাগার’। সবই আমার ‘তাকদীর’। পর্দায় তিনি জেল খেটেছেন চারবার। মৃত্যুদণ্ড হয়েছে দুইবার। একবার জেল থেকে পালিয়েছেন। ফাঁসিতে ঝুলেছেন একবার। জেলখানার সঙ্গে তার অন্যরকম আত্মীয়তা। নিজের অভিনয় জীবনে জেলখানার গল্প এভাবেই সোশ্যাল মিডিয়ায় বলেছেন তিনি। ‘মনপুরা’, ‘আয়নাবাজি’, ‘পাপ-পুণ্য’তে তার অভিনীত সোনাই, শরাফত করিম আয়না এবং খোরশেদ চেয়ারম্যানের হয়ে জেলে ছিলেন অনেকদিন। সবশেষ ‘কারাগার’-এর জন্য দীর্ঘদিন জেলে কাটালেন।

তাসনিয়া ফারিণ

‘কারাগার’ ওয়েব সিরিজে চঞ্চল চৌধুরী ও তাসনিয়া ফারিণ (ছবি: হইচই)

একঝাঁক অভিনয়শিল্পীর মিলনমেলা
‘কারাগার পার্ট-১’ সিরিজের গল্পে প্রচুর চরিত্র আছে। ফলে একঝাঁক অভিনয়শিল্পীর মিলনমেলা রয়েছে এতে। সাধারণ দর্শকদের দৃষ্টিতে, তাদের পারফরম্যান্স টপক্লাস। আলাদা করে ইন্তেখাব দিনারের প্রশংসা করেছেন অনেকে। তার সংলাপ ডেলিভারি দারুণ। প্রতিটি দৃশ্যে যেন নিজেই নিজের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেছেন। জেলার, স্বামী, বাবা ও বন্ধু হিসেবে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের সংগ্রাম দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি।

ইন্তেখাব দিনার

‘কারাগার’ ওয়েব সিরিজে ইন্তেখাব দিনার (ছবি: হইচই)

তাসনিয়া ফারিণ চরিত্রানুযায়ী অনেক ভালো কাজ দেখিয়েছেন। আফজাল হোসেন অল্প সময় থাকলেও অন্যরকম আবহ এনেছেন। বিজরী বরকতুল্লাহ, এফ এস নাইম, এ কে আজাদ সেতু, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, জাহিদ হোসেন শোভন, অশোক বেপারী, উজ্জ্বল কবির হিমু, আব্দুল্লাহ আল সেন্টু, পাভেল জামান, শাহাদাত শিশির, মীর নওফেল আশরাফি জিসান, মাঈন হাসান, ফারহানা হামিদসহ প্রত্যেকে নিজ নিজ চরিত্রে অনবদ্য ও প্রাণবন্ত।

চঞ্চল চৌধুরী

‘কারাগার’ ওয়েব সিরিজে চঞ্চল চৌধুরী (ছবি: হইচই)

কারিগরি দিক
কারিগরি দিক থেকে ‘কারাগার’ বেশ উন্নত বলেছেন সাধারণ দর্শক ও শিল্পীরা। ‘কারাগার’-এর দুর্দান্ত চিত্রনাট্যের প্রশংসা করেছেন অনেকে। গল্পের পাশাপাশি চিত্রনাট্য ছিলো গতিময়। সবকিছুই ‘টু দ্য পয়েন্ট’ উপস্থাপন করা হয়েছে। সিরিজটির কাহিনি, চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেছেন নেয়ামত উল্লাহ মাসুম। হইচই’য়ে মুক্তিপ্রাপ্ত সৈয়দ আহমেদ শাওকীর প্রথম ওয়েব সিরিজ ‘তাকদীর’ তিনিই লিখেছিলেন। নির্মাতা নোমান রবিনের কথায়, ‘ভদ্রলোক কী দুর্দান্ত লেখেন!’

বরকত হোসেন পলাশের চিত্রগ্রহণ ও সালেহ সোবহান অনীমের সম্পাদনা বেশ ভালো। রুসলান রেহমানের আবহ সংগীত দারুণ মানানসই। শিল্প নির্দেশক নাঈমা জাহান ধন্যবাদ পেতে পারেন। কস্টিউম ডিজাইন, মেকআপ ও কালার গ্রেডিং খুবই ভালো। সব মিলিয়ে সিরিজটি খুবই উপভোগ্য হয়ে উঠেছে দর্শকদের কাছে।

সিনেমাওয়ালা প্রচ্ছদ