Connect with us

গান বাজনা

ব্যান্ডে গাইতেন, সিনেমায় গান গেয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, কিন্তু তিনি ছিলেন চিত্রনায়ক

সিনেমাওয়ালা রিপোর্টার

Published

on

জাফর ইকবাল (জন্ম: ২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৫০, মৃত্যু: ৮ জানুয়ারি, ১৯৯২)

‘সুখে থেকো ও আমার নন্দিনী’, ‘হয় যদি বদনাম হোক আরও, আমি তো এখন আর নই কারও’, ‘এক হৃদয়হীনার কাছে হৃদয়ের দাম কী আছে’, ‘যেভাবেই বাঁচি, বেঁচে তো আছি’– কালজয়ী এসব গানের গায়ক ছিলেন একজন চিত্রনায়ক! তিনি জাফর ইকবাল। আশির দশকে ফ্যাশন আইকন ভাবা হতো এই দাপুটে নায়ককে। চিরসবুজ এই তারকার জন্মদিন আজ (২৫ সেপ্টেম্বর)।

জাফর ইকবাল প্রায় ২০০টি গান গেয়েছেন। আশির দশকের মাঝামাঝি প্রকাশিত হয় তার একক অ্যালবাম ‘কেন তুমি কাঁদালে’। দারাশিকো পরিচালিত ‘ফকির মজনু শাহ’ সিনেমায় অভিনয়ের পাশাপাশি আলাউদ্দিন আলির সুর ও সংগীতে রুনা লায়লার সঙ্গে দ্বৈত কণ্ঠে ‘প্রেমের আগুনে জ্বলে পুড়ে’ গানটি গেয়েছেন তিনি। তার গাওয়া গানের তালিকায় আরো আছে আলাউদ্দিন আলীর সুর-সংগীতে ‘শেষ কোরো না, শুরুতেই খেলা, না ভেঙো না’, গাজী মাজহারুল আনোয়ারের ‘সন্ধি’ সিনেমায় ‘জয় আবাহনী, জয় মোহামেডান’, ‘বিদেশ থেকে দেশে আইলে’। নায়করাজ রাজ্জাক নিজের পরিচালিত ‘বদনাম’ সিনেমায় জাফর ইকবালের গাওয়া গানে ঠোঁট মিলিয়েছেন।

শাহনাজ রহমতউল্লাহ ও জাফর ইকবাল (ছবি: ফেসবুক)

জাফর ইকবাল কারও কাছে গান শেখেননি। সুরের আবহে বেড়ে ওঠায় গান না শিখেও খুব ভালো গাইতে পারতেন। বড় ভাই অমর সুরস্রষ্টা আনোয়ার পারভেজ ও ছোট বোন কিংবদন্তি গায়িকা শাহনাজ রহমতউল্লাহকে কাছ থেকে দেখে নিজেও গাওয়ার চেষ্টা করতেন। ভাইবোনের মতো গানকে ভালোবাসতে শেখেন, গাইতে শুরু করেন।

জাফর ইকবাল গিটার বাজাতেন ভালো। ব্রিটিশ সংগীতশিল্পী এলভিস প্রিসলি ছিলেন তার প্রিয়। ১৯৬৭ সালে বন্ধু তোতা, মাহমুদ ও ফারুককে নিয়ে তিনি গঠন করেন র‌্যাম্বলিং স্টোনস নামের একটি ব্যান্ড। ১৯৬৮ সালে ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে প্রতি শনি ও রবিবার সংগীত পরিবেশন করতেন তারা।

জাফর ইকবাল (জন্ম: ২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৫০, মৃত্যু: ৮ জানুয়ারি, ১৯৯২)

১৯৬৯ সালে কনসার্টে গান গাইতে গিয়েই খান আতাউর রহমানের নজরে পড়েন জাফর ইকবাল। খান আতার পরিচালিত ‘আপন পর’ সিনেমার মাধ্যমে সেই বছর নায়ক হিসেবে বড় পর্দায় আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। তার নায়িকা ছিলেন কবরী। সিনেমাটিতে রয়েছে বশির আহমেদের গাওয়া কালজয়ী গান ‘যারে যাবি যদি যা, পিঞ্জর খুলে দিয়েছি, যা কিছু বলার ছিলো বলে দিয়েছি’। এর কথা ও সুর খান আতার।

জাফর ইকবাল (জন্ম: ২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৫০, মৃত্যু: ৮ জানুয়ারি, ১৯৯২)

জাফর ইকবালের ঠোঁট মেলানো কালজয়ী অনেক গান রয়েছে। তিনি বেশ কয়েকটি সিনেমায় গায়ক চরিত্রে অভিনয় করেছেন। সেগুলো দর্শকনন্দিত হয়েছে। এরমধ্যে অন্যতম বেলাল আহমেদ পরিচালিত ‘নয়নের আলো’। এর সব গান আজো শ্রোতাদের মুখে মুখে। এগুলো হলো– ‘আমার বুকের মধ্যিখানে/মন যেখানে হৃদয় সেখানে’, ‘আমার সারা দেহ খেয়োগো মাটি/এই চোখ দুটো তুমি খেয়ো না’, ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান/সেদিন থেকে গানই জীবন, গানই আমার প্রাণ’, ‘এই আছি এই নাই/বলো এই আছি এই নাই/দুদিন পরে কেউবা ধুলো/কেউবা হবো ছাই’।

বিটিভির একটি অনুষ্ঠানে গাইছেন জাফর ইকবাল (ছবি: বিটিভি)

বন্ধুত্ব নিয়ে নির্মিত ‘ভাই বন্ধু’ সিনেমায় দৃষ্টিহীন গায়কের চরিত্রে দেখা গেছে জাফর ইকবালকে। সিনেমাটির ‘ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা’ গানটি আজো শ্রোতাপ্রিয়। তার অভিনীত ‘বন্ধু আমার’ সিনেমার ‘একটাই কথা আছে বাংলাতে’ গানটিও অনেক জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো। এ তালিকায় আরো আছে ‘তুমি আমার জীবন’ (অবুঝ হৃদয়), ‘কতো যে তোমাকে বেসেছি ভালো, সে কথা তুমি যদি জানতে’ (উসিলা), ‘ওগো বিদেশিনী তোমার চেরি ফুল দাও’ (ওগো বিদেশিনী), ‘চাঁদের সাথে আমি দেবো না’ (আশীর্বাদ), ‘আমি তোমার মনের মতো কিনা’ (গর্জন), ‘শোনো সোমা একটু দাঁড়াও, কথা শুনে যাও’ (প্রতিরোধ), ‘এই যে দুনিয়া কীসেরও লাগিয়া’ (দোষী), ‘ফুল ফোটা ফাগুনে, মন পোড়া আগুনে’ (প্রেমিক)।

জাফর ইকবাল (জন্ম: ২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৫০, মৃত্যু: ৮ জানুয়ারি, ১৯৯২)

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন জাফর ইকবাল। স্বাধীনতার পর অভিনয়ে পুরোপুরি ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। জাফর ইকবাল প্রায় ১৫০টি সিনেমায় অভিনয় করেন। এগুলোর বেশিরভাগই ছিল ব্যবসাসফল। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য- আপন পর, ‘নয়নের আলো’, ‘বন্ধু আমার’, ‘সাধারণ মেয়ে’, ‘এক মুঠো ভাত’, ‘ফকির মজনু শাহ’, ‘সূর্যসংগ্রাম’, ‘বেদ্বীন’, ‘অংশীদার’, ‘আশীর্বাদ’, ‘মেঘ বিজলী বাদল’, ‘গৃহলক্ষ্মী’, ‘অপমান’, ‘প্রেমিক’, ‘ফুলের মালা’, ‘মিস লংকা’, ‘ভাই বন্ধু’, ‘অবদান’, ‘আবিষ্কার’, ‘উছিলা’, ‘অবুঝ হৃদয়’, ‘গর্জন’, ‘প্রতিরোধ’, ‘ওগো বিদেশিনী’, ‘সন্ধি’, ‘যোগাযোগ’, ‘চোরের বউ’, ‘সিআইডি’, ‘মর্যাদা’, ‘লক্ষ্মীর সংসার’। ববিতার সঙ্গে ৩০টি সিনেমায় জুটি বেঁধেছেন তিনি। এগুলো দর্শকনন্দিত হয়েছে।

ববিতা ও জাফর ইকবাল (ছবি: ফেসবুক)

ব্যক্তিজীবনে সনিয়া নামে একজনকে বিয়ে করেন নায়ক জাফর ইকবাল। তাদের দুই সন্তান। ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৯২ সালের ৮ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন জাফর ইকবাল। আজিমপুরে কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন তিনি। তার শূন্যতা আজো অনুভব করে ঢালিউড। ক্ষণজন্মা এই তারকা চির অমর হয়ে থাকবেন দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে।

সিনেমাওয়ালা প্রচ্ছদ