Connect with us

গান বাজনা

একজীবনে রুনা লায়লা: বলিউডে গান, গিনেস রেকর্ড, আটবার জাতীয় পুরস্কার, সিনেমায় অভিনয়

সিনেমাওয়ালা রিপোর্টার

Published

on

রুনা লায়লা (ছবি: ফেসবুক)

দেশবরেণ্য সংগীতশিল্পী রুনা লায়লাকে বলা হয় তারকাদের তারকা। সবশ্রেণির জনপ্রিয়তা, সাফল্য আর প্রাপ্তিতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের গানের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন তিনিই। অনন্য কণ্ঠ, অধ্যবসায়, একাগ্রতা, চর্চা, সময়জ্ঞানে তার তুলনা শুধু তিনিই। আজ (১৭ নভেম্বর) তার জন্মদিন। পরিবার, স্বজন, শিল্পী ও ভক্তদের শুভেচ্ছায় সিক্ত হয়েছেন গুণী এই শিল্পী।

১৯৫২ সালের ১৭ নভেম্বর সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন রুনা লায়লা। বাবা এমদাদ আলী ছিলেন পাকিস্তানের ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা। সেজন্য মা আমিনা লায়লা, বড় বোন দিনা লায়লা ও ভাই সৈয়দ আলী মুরাদসহ তাকে পাকিস্তানেই শৈশব কাটাতে হয়েছে। ১৯৬৫ সালের জুনে মনজুর হোসেনের সংগীত পরিচালনায় উর্দু সিনেমা ‘জুগনু’র দুটি গানে কণ্ঠ দেন তিনি। এগুলো হলো ‘গুড়িয়া সি মুন্নি মেরি ভাইয়া কি পেয়ারি’ এবং ‘মারনা ভি নাহি আসান’। এর পরের বছর পাকিস্তানি সিনেমা ‘হাম দোনো’তে তার গাওয়া ‘উনকি নজরো সে মোহাব্বত কা জো পয়গাম মিলা’ ব্যাপক শ্রোতাপ্রিয়তা পায়।

রুনা লায়লা (ছবি: ফেসবুক)

১৯৬৫ সাল থেকে দীর্ঘ পাঁচ দশকে শ্রোতাদের অসংখ্য কালজয়ী গান উপহার দিয়েছেন রুনা লায়লা। যুগের পর যুগ সংগীতপিপাসুদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছেন তিনি। তার গানের সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি। বাংলা, হিন্দি, উর্দু, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, গুজরাটি, পশতু, বেলুচি, আরবি, পারসি, মালয়, নেপালি, জাপানি, ইতালিয়ান, স্প্যানিশ, ফরাসি ও ইংরেজিসহ ১৭টি ভাষায় গান করেছেন তিনি।

পাকিস্তান রেডিওর ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসে প্রথম বাংলা গানে কণ্ঠ দেন রুনা লায়লা। দেবু ভট্টাচার্যের সুর করা গান দুটি ছিলো ‘নোটন নোটন পায়রাগুলো’ ও ‘আমি নদীর মতো পথ ঘুরে’।

১৯৭০ সালে বাংলা সিনেমার জন্য রুনা লায়লা প্রথম গেয়েছেন ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে’। গাজী মাজহারুল আনোয়ারের কথা ও সুবল দাসের সুরে এটি তৈরি হয় ‘স্বরলিপি’ সিনেমার জন্য। একই গানে কণ্ঠ দিয়েছেন মাহমুদুন্নবী। লাহোরের বারী স্টুডিওতে এর রেকর্ডিং হয়।

রুনা লায়লা (ছবি: ফেসবুক)

১৯৭৪ সালে পরিবারের সঙ্গে বাংলাদেশে চলেন আসেন রুনা লায়লা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি প্রথম গেয়েছেন সত্য সাহার সুরে ‘জীবন সাথী’ সিনেমায়। তার সহশিল্পী ছিলেন খন্দকার ফারুক আহমেদ। একই বছর কলকাতায় ‘সাধের লাউ’ গানটি নতুন সংগীতায়োজনে রেকর্ড করেন তিনি। এটি এবং ‘দমা দম মাস্ত কালান্দার’ গান দুটি দিয়ে ভারত জুড়ে জনপ্রিয়তা পান তিনি। ১৯৭৪ সালে মুম্বাইয়ে প্রথমবার কনসার্টে সংগীত পরিবেশন করেন।

১৯৭৬ সালে কল্যাণজি-আনন্দজির সুরে ‘এক সে বাড়কার এক’ সিনেমার টাইটেল গান গেয়ে বলিউডে পা রাখেন রুনা লায়লা। হিন্দি সিনেমায় তার গাওয়া গানের তালিকায় রয়েছে– জয়দেবের সুরে ‘তুমহে হো না হো’, ‘মুঝে পেয়ার তুমসে নেহি হ্যায়’ ও ‘দো দিওয়ানে শেহার মে’ (সহশিল্পী: ভূপিন্দর সিং; ঘারোন্দা, ১৯৭৭), বাপ্পি লাহিড়ীর সুরে ‘মার গ্যায়ো রে’ (সহশিল্পী: মোহাম্মদ রফি; জান-এ-বাহার, ১৯৭৯), ‘কাহো সখি কাহো’ (সহশিল্পী: বাপ্পি লাহিড়ী; এক দিন বহু কা, ১৯৮৩), ‘অ্যায় দিলওয়ালে আও’ (ইয়াদগার, ১৯৮৪) ও ‘জান মেরি জান’ (সাজান কে লিয়ে, ১৯৯৫), এম. আশরাফের সুরে ‘ও মেরা বাবু ছেইল ছেবিলা’ (ঘর দুয়ার, ১৯৮৫), লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারেলালের সুরে ‘আলি বাবা মিল গ্যায়া চালিস চোরো সে’ (অগ্নিপথ, ১৯৯০) ও ‘ম্যায় কালি আনার কি’ (সহশিল্পী: আদেশ শ্রীবাস্তব; স্বপনো কা মন্দির, ১৯৯১)।

‘ও মেরা বাবু ছেইল ছেবিলা’ ছিলো পাকিস্তানের ‘মান কি জিত’ (১৯৭২) সিনেমার গান। পরে এটি ব্যবহার হয় বলিউডের ‘ঘর দুয়ার’ (১৯৮৫) সিনেমায়।

১৯৮২ সালের ১ ডিসেম্বর বাপ্পি লাহিড়ীর সুরে রুনা লায়লার ‘সুপারুনা’ অ্যালবামটি ইএমআই মিউজিক কোম্পানি প্রকাশের প্রথম দিনেই ১ লাখ কপি বিক্রি হয়। এজন্য উপহার হিসেবে গোল্ডেন ডিস্ক অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন তিনি। অ্যালবামটির কাজ হয়েছিলো লন্ডনে, যেখানে বিটলস গান রেকর্ডিং করতো।

রুনা লায়লা (ছবি: ফেসবুক)

নব্বইয়ের দশকে মুম্বাইয়ে পাকিস্তানি সংগীত পরিচালক নিসার বাজমির সুরে একেক দিনে ১০টি করে তিন দিনে ৩০টি গানে কণ্ঠ দেন রুনা লায়লা। এটি ছিলো বিশ্বরেকর্ড। ফলে তার নাম লেখা হয় গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে। এর আগেও নিসার বাজমির সুর করা ক্লাব সং, স্যাড সং, ক্লাসিক্যাল, গজল, গীতসহ বিভিন্ন ধরনের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি।

রুনা লায়লা মোট আটবার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। তার কালজয়ী গানের তালিকায় রয়েছে ‘যখন আমি থাকবো নাকো’, ‘বুকে আমার আগুন জ্বলে’, ‘যখন থামবে কোলাহল’, ‘শিল্পী আমি তোমাদেরই গান শোনাবো’, ‘আয়রে মেঘ আয়রে’, ‘এই বৃষ্টিভেজা রাতে’, ‘আমার মন বলে তুমি আসবে’, ‘পাখি খাঁচা ভেঙে উড়ে গেলে’, ‘বন্ধু তিন দিন তোর বাড়িত’, ‘সুখ তুমি কী বড় জানতে ইচ্ছে করে’, ‘পান খাইয়া ঠোঁট লাল’ প্রভৃতি। দেশের গানের তালিকায় উল্লেখযোগ্য– ‘প্রতিদিন তোমায় দেখি সূর্যরাগে’, ‘হায়রে আমার মন মাতানো দেশ’, ‘আমায় গেঁথে দাও না মাগো’।

বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত বেশ কিছু ভেন্যুতে সংগীত পরিবেশন করেছেন রুনা লায়লা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য– রয়্যাল অ্যালবার্ট হল, ওয়েম্বলি স্টেডিয়াম, ওয়েম্বলি কনফারেন্স সেন্টার, মেডিসন স্কয়ার গার্ডেন, লিংকন সেন্টার নিউইয়র্ক, সিডনি অপেরা হাউস।

১৯৯৯ সালে জিটিভির ‘সারেগামাপা’ (হিন্দি) প্রতিযোগিতায় প্রধান বিচারক ছিলেন রুনা লায়লা। তার সঙ্গে আরো ছিলেন মেহেদি হাসান, গুলাম আলী, ফরিদা খানম ও জগজিৎ সিং। অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেন সনু নিগাম। জি বাংলার ‘সারেগামাপা বিশ্বসেরা’ প্রতিযোগিতায় রুনার সঙ্গে বিচারক ছিলেন কুমার শানু ও শান্তনু মৈত্র। বাংলাদেশ, ভারত আর পাকিস্তানের প্রতিযোগীদের নিয়ে ২০১২ সালে দুবাইয়ে আয়োজন করা হয় ‘সুরক্ষেত্র’। রুনা লায়লা ছাড়াও এতে বিচারক ছিলেন আশা ভোঁসলে ও আবিদা পারভীন। বাংলাদেশে চ্যানেল আইয়ের ‘সেরাকণ্ঠ’ এবং চ্যানেল নাইনের ‘পাওয়ার ভয়েস’ প্রতিযোগিতায় বিচারক ছিলেন তিনি।

শুধু গান নয়, বড় পর্দায় অভিনয় করেছেন রুনা লায়লা। ১৯৯১ সালে চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘শিল্পী’ সিনেমায় নাম ভূমিকায় দেখা গেছে তাকে। তার জীবনের কিছু গল্প বলা হয়েছে এতে। সিনেমাটির নায়ক ছিলেন আলমগীর। এরপর তারা বাস্তবে বিয়ের বন্ধনে জড়ান।

সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের সহায়তায় কাজ করেছেন রুনা লায়লা। সার্ক এবং ইউএনএইডসের শুভেচ্ছাদূত হিসেবে সচেতনতা বৃদ্ধি করেছেন। বড় বোন দিনার মৃত্যুর পর ঢাকায় শিশু হাসপাতালে ক্যানসারে আক্রান্ত শিশুদের জন্য একটি ওয়ার্ড গড়েছেন।

Advertisement

সিনেমাওয়ালা প্রচ্ছদ